মস্তিষ্ক, ফাঁসি ও আমাদের আসাদুজ্জামান শাহিনঃ সমকালীন চিন্তাভাবনার সাক্ষাৎকার

 

কবি আসাদুজ্জামান শাহীন। একজন বিদ্রোহের মন্ত্রে উজ্জীবিত কবিতাযুদ্ধের সৈনিক। ২০২৪ বইমেলায় লিখেছেন "মস্তিষ্কের ফাঁসি চাই" শিরোনামে কাব্যগ্রন্থ। কিছু প্রশ্ন নিয়ে বইখবর হাজির হয়েছিলো তার দুয়ারে। চলুন কবির মূল্যবান কিছু কথা শুনে আসি।


প্রশ্ন ১

মস্তিষ্কের ফাঁসি চাওয়া হলো কেনো?

-আসলে প্রথমে মস্তিষ্কের ফাঁসি চেয়েছিলাম নিজের জন্যে, পরে পাঠকের জন্য। দেখুন, সমাজের এই যে অন্যায় অবিচার, জুলুম নির্যাতন,না পাওয়ার আক্ষেপ এই যে চারপাশে মানুষের এত  এত হাহাকার- এই সমস্ত আমাকে খুব ভাবায় খুব পীড়া দেয় মস্তিষ্কে, কিন্তু আমার না আছে কোন ঐশ্বরিক ক্ষমতা না আছে সামাজিক/রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা। যে ক্ষমতা বলে আমি এসবের নিষ্কাশন করতে পারবো। একদিকে এই নিষ্কাশন করতে পারছি না অন্যদিকে মস্তিষ্কের জ্বালা বেড়েই চলেছে, ভাবনা চিন্তা পীরা দিয়েই যাচ্ছে, মনে হয় যেন আমি একটা মানসিক কয়েদখানায় আছি, সেই কয়েদখানা থেকে মুক্তি পেতেই আমি আমার মস্তিষ্কের ফাঁসি চেয়েছি, নিদেনপক্ষে যেন এই অপরাধবোধ, মস্তিষ্কের এই পীড়া থেকে বাঁচতে পারি। এবং যে সকল পাঠকেরা একইভাবে মস্তিষ্কের কয়েদখানায় আটক আছে তাদের জন্য এই ফাঁসির আহবান।

প্রশ্ন ২

কবি হিসেবে জীবন কেমন, ডেভেলপার হিসেবে জীবন কেমন?

এই প্রশ্ন করলে আমার উত্তর হবে, আমি মূলত একজন সফটওয়্যার ডেভেলপারই, কবি হিসেবে নিজেকে পরিচয় দিতে সংকোচ বোধ করি, আমি মনে করি- লেখক লেখে না, বরং লেখাই লেখক তৈরি করে। আমি কবিতা লিখছি ঠিক কিন্তু পাঠক সমাজ আমাকে কবি হিসেবে মেনে নিয়েছে কিনা নিলেও কতখানি নিয়েছে তার উপর নির্ভর করছে আমি কবি হতে পেরেছি কিনা। তবে যখন কবি সত্তা ভর করে তখন নিজেকে উন্মাদ উন্মাদ লাগে, এর বিশেষ কারণ হচ্ছে আমার ভেতরে কেন জানি বার বার বিদ্রোহই জন্ম নেয়, এই সমাজ রাষ্ট্রের নানা ক্ষোভ আমার ভিতরে জন্ম নিয়ে কবিতা হয়ে বেড়িয়ে আসতে চায়, তখন কিছুটা উন্মাদ উন্মাদ লাগে, জগৎ সংসারের বাইরে চলে যেতে ইচ্ছা হয়। এ জীবন ও খারাপ না, সকল শ্রেণীর মানুষের সাথে কথা বলা যায়, সমাজ প্রকৃতি জড় সর সবার সাথেই কথা বলা যায় এটা অন্য রকম আরেক জীবন।

ডেভেলপার হিসেবে জীবনটাও খারাপ না। আমার আসলে জটিল জটিল বিষয় নিয়ে ভাবতে, চিন্তা করতে ভালোলাগে। ছোট বেলায় এক ভাবনা ছিল আমি বিজ্ঞানী হবো, আমাকে কিছু একটা আবিষ্কার করতেই হবে । সে জায়গা থেকে প্রফেশনটা আমার যোতসই, বিজ্ঞানী না হতে পারলেও নতুন কিছু বানাতে পারছি, প্রযুক্তির সাথে উঠাবসা করছি, এটাও মন্দ কি? কবিতা এবং কোডিং দুটোর প্রতিই আমার আঘাত প্রেম আছে, আলাদা এক ভালোলাগা কাজ করে। যখন কোড লিখি তখনো মনে হয় কবিতাই লিখছি। পাকস্থলির ক্ষিদে মেটাতে কোড আর মস্তিষ্কের ক্ষিদে মেটাতে লিখি কবিতা এই যা। দুই জীবনেই ভালো আলহামদুলিল্লাহ।

প্রশ্ন ৩

লাইক, রি এক্ট, কমেন্ট ও ফলোয়ার এইসমস্ত বিষয়বস্তু কি একজন লেখকের স্বাধীন চিন্তায় প্রভাব বিস্তার করে?

-         মানুষের জীবন আসলে এখন দুইটা, একটা একচুয়াল লাইফ, এবং ভার্চুয়াল লাইফ। লেখক যখন তার জায়গা থেকে কোন কিছু ভাবে সেটা অবশ্যই একচুয়াল লাইফ অর্থাৎ বাস্তবিক ভাবেই ভাবে, কিন্তু একচুয়াল লাইফের ভাবনা চিন্তা ভার্চুয়াল লাইফের পাতায় অনেক সময় খাপ খায় না, তাই কিছু কিছু জায়গায় সোশ্যাল মিডিয়াটা একজন লেখকের স্বাধীন চিন্তায় উপর প্রভাব বিস্তার করে বলেই আমার মনে হচ্ছে। সোশ্যাল মিডিয়াটা যেমন লেখার জায়গা কে প্রশস্ত করেছে অনেকাংশে বিস্তৃত করেছে তেমনই কিছু দায়বদ্ধতাও তৈরি করেছে, সোশ্যাল মিডিয়া যেহেতু পাঠকের সাথে লেখকের একটা সরাসরি ইন্টার‍্যাক্ট ক্রিয়েট করছে সেহেতু লেখক মুক্তচিন্তা থেকে কিছু একটা লিখার পর পাঠকের যুক্তিযুক্ত না হলে ,পাঠকের বোধগম্য না হলেই মন্তব্য ঠুকে দিচ্ছে, গালমন্দ করছে। অনেককেই দেখেছি কোন একটা বিষয় নিয়ে  সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করার কিছুক্ষণ বাদেই পাঠকের তোপের মুখে পড়ে লেখা মুছে দিচ্ছে। এসব কিছু বিষয় খেয়াল করেছি অনেক লেখকের মাঝে। এমনটা হওয়া উচিত নয়, আপনি  একটা কথা বললে ১০ জনের সবাই সেটার পক্ষে থাকবে বিষয়টা এমন না, এক্ষেত্রে লেখকের উচিত নিজের চিন্তাধারাকে অব্যাহত রাখা।  তবে এই বিষয়টাকেও একেবারে খারাপভাবে দেখা উচিত নয়, পাঠকের সাথে লেখকের এই সরাসরি যোগাযোগ বরং লেখককে তার ভুল ব্যাখ্যা থেকে বের হয়ে আরো চিন্তাশৈলী বানাতে পারে।

 

প্রশ্ন ৪

কবিতার কলম না গদ্যসাহিত্যের কলম শক্তিশালী? নিজেকে নজরুলের উত্তরসূরি ভাবতে কেমন বোধ হয়?

-         গদ্য সাহিত্য একটা সমাজের সাথে আরেকটা সমাজের নিভির ভাবে পরিচয় করিয়ে দেয় সত্য তবে আমি মনে করি কবিতা মানুষের বোধকে জাগ্রত করে। একটা ভালো কবিতা কিন্তু আপনাকে যুদ্ধে যাবার মতো শক্তি যোগাতে পারে, কিন্তু গদ্য তা পারে না, গদ্য যেটা পারে সেটা যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে এসে সামাজিক পরিবর্তন ঘটাতে পারে, সমাজের সাথে অন্য আরেকটা সমাজের পরিচয় করিয়ে দিতে পারে। দুটোর প্রয়োজনিয়তাই অধিক তবে আমার কাছে মনে হয় কবিতার মতো কবিতা গদ্যসাহিত্যের চেয়ে ঢের শক্তিশালী।

-         নিজেকে নজরুলের উত্তরসূরি ভাবতে কেমন বোধ হয়? এভাবে ভাবলে আসলে আলাদা একটা স্পৃহা জন্মায়, যদিও এই দুঃসাহস আমি দেখাই না। আমি নিজেকে নজরুলের ছাত্র মনে করি, যেমনভাবে আমি অদেখা  আহম্মদ সফার একজন  ছাত্র। কবিতার সাথে যেদিন থেকে সন্ধি হয়েছে সেদিন থেকে নজরুলের কবিতা, গান শুনে শুনেই পথ চলা । হয়তবা এ কারণেই আমার কবিতায় প্রেম না এসে বার বার বিদ্রোহ আসে। তবে মুখে মুখে যাই বলি- আমার কবিতা পড়ে যখন কেউ নজরুলের সঙ্গে নাম জুড়ে দেয় তখন মনে মনে কিন্তু বেশ খুশিই হই, ভালোই লাগে।

 

প্রশ্ন ৫

আগামী পাঁচ বছরে নিজের লেখনিকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?

কঠিন প্রশ্ন, মানুষ যতই বুদ্ধিমান প্রাণী হোক না কেন, কেউই তার ভবিষ্যৎ দেখতে পায় না। ভবিষ্যৎ ভবিষ্যতের কাছেই ছেড়ে দিলাম। তবে নিজেকে যদি মূল্যায়নের কথায় আসি তবে আমার একটা ভাবনার কথা বলতে পারি- আমি সমাজকে একটা নাড়া দিতে চাই আগামী ৫-৭ বছরে। সমাজের ঘুমন্ত মানুষকে জাগাতে চাই। আমার চিন্তা ভাবনাকে রূপ দিতে চাই-বিকলাঙ্গ বুদ্ধিজীবী সমাজকে বুদ্ধিজীবী শব্দের সাথে পুনরায় পরিচয় করিয়ে দিতে চাই। যদি করতে পারি তবে আগামী সময়ের মূল্যায়ন হতে পারে বর্তমান সময়ের একমাত্র বুদ্ধিজীবী সলিমুল্লাহ খান দের মতো চিন্তাবিদদের সাথে একই টেবিলে সামাজিক ব্যাধি নিয়ে টকশো করা, বাকিটা কর্ম আর কল্যাণ মূল্যায়ন করবে সময়মতো

Comments

Popular posts from this blog

পৃথিবীর সব সুর থেমে যাওয়ার পর কি হবে?

বইমেলা ২০২৪ এ আসছে রাগিব নিযামের "এক ডজন ভয়"